অধ্যাপক ডাঃ কাজল কান্তি চৌধুরী:
এক মানবিক চিকিৎসকের প্রবন্ধচিত্র।
নেত্রকোণার জেলার খালিয়াজুরি উপজেলার ইছাপুর গ্রামের একটি আলোকজ্জ্বল পরিবারের কৃতি সন্তান অধ্যাপক ডাঃ কাজল কান্তি চৌধুরী তিনি আজ আর আমাদের মধ্যে নেই।তিনি গত ৯ এপ্রিল ২০২৫ ইং তারিখে ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় পরলোক গমন করেন।আমি তাঁর আত্মার চিরশান্তি ও মঙ্গল কামনা করি।
বর্তমান সমাজে চিকিৎসা পেশা অনেকাংশেই বাণিজ্যিকীকরণের পথে হাঁটছে,যেখানে রোগী অনেক সময় একটি সংখ্যায় পরিণত হয়। কিন্তু এই পেশায় কিছু মানুষ ছিলেন এবং আছেন—যারা চিকিৎসাকে শুধুমাত্র পেশা নয়, এক মানবিক দায়িত্ব ও সেবার মহান ব্রত হিসেবে গ্রহণ করেছেন। তেমনই একজন অনন্য চিকিৎসক ছিলেন ডাঃ কাজল কান্তি চৌধুরী, তিনি তৎকালীন সময়ে কমিউনিটি বেইজড ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের প্রাক্তন সার্জন ও সার্জারী বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ছিলেন।
তাঁর পরিচয় শুধুমাত্র একটি পদ-পদবী দিয়ে সীমাবদ্ধ করার নয়। তিনি ছিলেন এমন একজন চিকিৎসক, যিনি কোনোদিন পদমর্যাদার গণ্ডিতে নিজেকে আবদ্ধ করেননি। মানুষের আর্তনাদই ছিল তাঁর কাছে সবচেয়ে বড় ডাক। সরকার যদি সময়মতো তাঁর মূল্যায়ন করত, তাহলে আজ তিনি হতেন দেশের চিকিৎসাবিজ্ঞানের অগ্রদূতদের একজন—যাঁর গৌরবে আমরা গর্ব করতে পারতাম।
ডাঃ কাজল কান্তি চৌধুরীর চিকিৎসা জীবন ছিল এক মহৎ সাধনার প্রতীক। তিনি ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের ম-৫ম ব্যাচের ছাত্র ছিলেন।পরবর্তীতে তিনি একই কলেজের চিকিৎসক হয়েছিলেন।
মহান চিকিৎসায় সেবায় তিনি জনপ্রিয়তার শীর্ষে ছিলেন।
তিনি ছিলেন সেই বিরল মানুষদের একজন, যিনি অর্থের অভাবে কোনো রোগীকে ফিরিয়ে দিতেন না। অপারেশনের মতো জটিল চিকিৎসাও তিনি বিনামূল্যে করে দিতেন। অনেক সময় রোগীর পরিবারের কেউ উপস্থিত না থাকলে, তিনি নিজেই অভিভাবকের ভূমিকা গ্রহণ করতেন। কারণ তিনি জানতেন, ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে যেসব রোগী আসতেন, তাদের অনেকেই হাওরবেষ্টিত অঞ্চল—খালিয়াজুরি, ধর্মপাশা, মধ্যনগর,শাল্লা, জামালগঞ্জ, মোহনগঞ্জ, মদন, কলমাকান্দা ইত্যাদি থেকে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে আসতেন।এতে রোগীর অভিভাবকের অনিচ্ছা সত্ত্বেও অনেক কালক্ষেপন হয়ে যাওয়ার ফলে রোগী আরও বেশি সংকটাপন্ন হয়ে যেত।
এই জনদরদি চিকিৎসকের প্রতি আমার ব্যক্তিগত শ্রদ্ধা শুধু শ্রুতির ওপর নয়—আমার জীবনের অভিজ্ঞতার সঙ্গেও ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আমার মা,বড় ভাই ও মায়ের পিতা আমার দাদুর চিকিৎসার সুবাদে আমার বাবা দীর্ঘ পাঁচ মাস তাঁর সরাসরি সান্নিধ্যে ছিলেন।আমি নিজেও আমার আত্মীয়-স্বজনের চিকিৎসার সুবাদে উনার স্নেহ বৎসল সান্নিধ্য পেয়েছি।সে সময় তাঁকে কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য আমার পরিবারের কারণে আমারও হয়েছিল। উপরন্তু, তিনি আমাদের গ্রামের সন্তান এবং তিনি আমার বাবাকে কাকু বলে ডাকতেন এবং তাদের সম্পর্ক ছিল বন্ধু বৎসল। তাই ব্যক্তিগত ও পারিবারিক পর্যায়েও তাঁর মানবিক গুণাবলি আমরা প্রত্যক্ষ করেছি।
কিন্তু একটি নিষ্ঠাবান, পরোপকারী মানুষের জীবনও নানা রকম চক্রান্ত ও ঈর্ষার শিকার হতে পারে—ডাঃ চৌধুরী তার এক অনাকাঙ্ক্ষিত উদাহরণ। সহকর্মীদের ঈর্ষা, অপপ্রচার ও ষড়যন্ত্রের ফলে তাঁর বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা রুজু হয় এবং তাঁকে একদিনের জন্য কারাগারে পাঠানো হয়। পরবর্তীতে তাঁকে রংপুরে বদলি করা হয়, যাতে তিনি আধুনিক চিকিৎসার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হন। এক পর্যায়ে তিনি সরকারি চাকরি থেকে পদত্যাগ করেন এবং আর কখনও সেই সরকারি চাকরীতে ফিরে আসেননি।কিন্তু ব্যক্তিগত বা বেসরকারি ভাবে তিনি তার আপন মহান কর্ম চিকিৎসা সেবা ঠিকই চালিয়ে গেছেন আমৃত্যু।
আজ যাঁরা তাঁকে চিনতেন, তাঁর সান্নিধ্য লাভ করেছিলেন, এমনকি এক সময় যাঁরা সমালোচনাও করতেন, তারাও এখন বলেন—তিনি ছিলেন একজন প্রকৃত চিকিৎসক। তার জীবন, চরিত্র ও চিকিৎসা দর্শন আজও আমাদের অনুপ্রাণিত করে।
ডাঃ কাজল কান্তি চৌধুরীর মতো মানুষদের আমরা যতদিন স্মরণ করব, ততদিন আমাদের সমাজে মানবিকতা, সততা আর নিষ্ঠার আলো জ্বলে থাকবে। তাঁর মতো চিকিৎসকরা ইতিহাসে না থাকলেও, মানুষের হৃদয়ে বেঁচে থাকেবেন চিরকাল।